রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০২৩

ইমাদ পরিবহনের বাস দুর্ঘটনা, ভয়ংকর রহস্য উন্মোচন - স্বপ্ন বার্তা

 


জাহিদ হাসান (৪০) সাত মাস আগে ইমাদ পরিবহনে চালক হিসেবে যোগ দেন। এসব পরিবহনের বাস খুলনা, পিরোজপুর ও সাতক্ষীরা থেকে রাজধানী ঢাকায় চলাচল করে। প্রায় বিরামহীন বাস চালাতে হচ্ছে পরিবহন কোম্পানির চালকদের। জাহিদ হাসানকেও ক্লান্ত শরীর আর তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে বাস চালাতে হয়েছে। বলাই বাহুল্য তিনি বিশ্রামের সময় পাননি। আর ফলাফল দেখা গেছে গতকাল রোববার সকালে।

চালক জাহিদ হাসান গতকাল ভোরে ইমাদ পরিবহনের বাসে করে খুলনা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় পদ্মা সেতু এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে তার বাস। এতে তিনিসহ ১৯ যাত্রী নিহত হন। হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ক্লান্ত চোখে ও ঘুমন্ত চোখে অতিরিক্ত গতিতে বাস চালানোর কারণে এত প্রাণহানি হয়েছে। জাহিদ হাসানের ছেলে আরও জানান, তার বাবা একটানা বাস চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।


দুর্ঘটনায় নিহত ১৯ জনের মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে স্থানীয় প্রশাসন। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সর্বশেষ চালকের সহকারী ইউসুফের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশ পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।


বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্র জানায়, বাসটির চলাচলের অনুমতি ছিল না। ফিটনেস সার্টিফিকেটের মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছিল।

হাইওয়ে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকালে ইমাদ পরিবহনের বাসটি খুলনার ফুলতলা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভোর ৫টা ৫ মিনিটে খুলনার সোনাডাঙ্গা থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় বাসটি। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পদ্মা সেতুতে পৌঁছানোর আগেই এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারান বাসটির চালক। বাসটি এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে পড়ে যায়। এর পর বাসটি এক্সপ্রেসওয়ে আন্ডারপাসের অন্তত ১০০ ফুট নিচের দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই চালক জাহিদ হাসান ও তার সহকারী ইউসুফসহ ১৭ জন নিহত হন। ১২ জনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে বাসের সুপারভাইজার মিনহাজসহ আরও এক যাত্রী মারা যান।


ড্রাইভার ক্লান্ত এবং ঘুমন্ত ছিল


বৃহস্পতিবার ঢাকার দোলাইরপাড়ের বাসা থেকে বের হন ইমাদ পরিবহনের চালক জাহিদ হাসান। সে রাতেই যাত্রীবাহী বাসে করে পিরোজপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পরদিন শুক্রবার সকালে পিরোজপুর থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন তিনি। শুক্রবার দুপুরে আবারও যাত্রী নিয়ে পিরোজপুরে ছুটে যান তিনি। রাতে পিরোজপুরে পৌঁছে শনিবার সকালে আবার যাত্রী নিয়ে ঢাকায় ছুটে যান। শনিবার বিকেলে ঢাকা থেকে আবার খুলনায় রওনা হয়। রাতে বাসে তিন থেকে চার ঘণ্টা বিশ্রামের পর রোববার ভোর চারটায় খুলনার ফুলতলা থেকে ঢাকার উদ্দেশে বাসে ওঠেন তিনি। এভাবে গত ৪৮ ঘণ্টায় ৩০ ঘণ্টার বেশি বাস চালানোর পর তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন।


গতকাল দুপুরে জাহিদের ছেলে রাতুল হাসান বাবার লাশ শনাক্ত করতে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। বললেন, 'সপ্তাহে একদিন বাসায় আসার সুযোগ পান বাবা। সে সব সময় গাড়ি চালাতে ক্লান্ত থাকে। বৃহস্পতিবার বাড়ি ছেড়ে ঢাকা, পিরোজপুর, খুলনা রুটে পাঁচটি ট্রিপ করেছেন তিনি। শনিবার রাতে বাবা ফোনে বলেন, তিনি খুব ক্লান্ত। রোববার ঢাকায় ফিরে বাসায় একদিন বিশ্রাম নেবেন বলে জানান। কিন্তু বাবা আমাদের এড়িয়ে চলে গেলেন অনন্ত বিশ্রামে।


চালকদের ব্যস্ততা ও বিশ্রামের অভাবের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইমাদ পরিবহনের ব্যবস্থাপক (অপারেশন) ওয়াহিদুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, আমাদের কোম্পানির বাকি বাস চালকদের জন্য রুম আছে। বাসের চালক জাহিদ। দুর্ঘটনায় জড়িত, ক্লান্ত, তিনি আমাদের কাউকে বলেনি।


শিবচর হাইওয়ে পুলিশের ওসি আবু নাঈম চালকের ক্লান্তি সম্পর্কে মো. মোফাজ্জেল হকও। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি ইমাদ পরিবহনের বাসের চালক বিশ্রাম না নিয়ে বাসটি চালাচ্ছিলেন। দীর্ঘক্ষণ বাস চালাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি। ভোরে বাস চালাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারান তিনি।


এদিকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু হয় এক্সপ্রেসওয়ে। ফরিদপুরে পদ্মা সেতুসহ ৭৫ কিলোমিটার সড়কের কাজ শেষ হয়েছে। এরপর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন সড়কে যানবাহন চলাচল করে। সরকার এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহনের গতি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করেছে। কিন্তু চালকরা ঘণ্টায় 100 থেকে 120 কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালান। এর আগে 17 জানুয়ারি, একটি রোগী বহনকারী একটি অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানোর সময় একটি ট্রাকের পিছনে ধাক্কা দেয়। এতে ছয়জন নিহত হয়। জাজিরা সড়কের নাওডোবা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।


গতকাল ইমাদ পরিবহনের বাসটি অতিরিক্ত গতিতে চলছিল। বাসের যাত্রী ছিলেন খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামুদর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সাইফুল ইসলাম। তিনি বাসের পিছনে বসে ছিলেন।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: